
ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য। তারপর পৌরসভার কাউন্সলর। এরপর মেয়র। প্রথম জীবনে চাঁদা তুলে সংসার চললেও এই মেয়রের ঘরেই মিলেছে কোটি টাকা। ছিলো অস্ত্র, গুলি এবং মাদকেরও মজুত। পুলিশ তাঁর স্ত্রী এবং দুই ভাতিজাকে গ্রেপ্তার করেছে। তিন দিন লাপাত্তা থাকার পরে আজ ভোরে কোটিপতি সেই মেয়রকে পুলিশ ঈশ্বরর্দী থেকে আটক করেছে।
এই মেয়রের নাম মুক্তার আলী। তিনি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌরসভার মেয়র। মুক্তারের উঠে আসার কাহিনী শুধু কুটকৌশলে ভরা। কখনও ষড়যন্ত্র করে, কখনও নির্যাতন অথবা ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করেছেন তিনি। জনপ্রতিনিধি হয়েই হয়েছেন বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক। চলাচল করেন বেপরোয়া। প্রায় সব সময়ই মদ্যপ অবস্থায় থেকে মারধর করেন যাকে ইচ্ছে।
সবশেষ এক কলেজশিক্ষককে মারধর করেই ফেঁসে গেছেন আড়ানীর ত্রাস মুক্তার। ঘটনাটি গেল মঙ্গলবার রাতের। মেয়রের প্রভাব খাটিয়ে লকডাউনের মধ্যেও দোকান খুলে হালখাতা করছিলেন তাঁর বেয়াই শামীম উদ্দিন। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে শামীমকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এতে ক্ষুব্ধ হন মেয়র। রাতেই তিনি পৌর এলাকার সব দোকানপাট দেখতে বের হন।
দোকান খুলে রাখায় তিনি কয়েকজন ব্যবসায়ীকে পেটান। এরপর যান মনোয়ার হোসেন নামে এক কলেজ শিক্ষকের ওষুধের দোকানে। এই মনোয়ার গত পৌরসভা নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করেছিলেন। আর মুক্তার ছিলেন নৌকার ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী। সুযোগ পেয়ে মেয়র এই শিক্ষককে দলবল নিয়ে পেটান। এ নিয়ে রাতেই মামলা করেন শিক্ষক মনোয়ার হোসেন। আসামি হন মেয়র মুক্তার।
এরপর এই রাতেই পুলিশ মেয়রকে ধরতে তাঁর বাসায় অভিযান চালায়। মেয়রকে না পাওয়া গেলেও পাড়িতে মেলে একটি অবৈধ বিদেশী পিস্তল, একটি ওয়ান শ্যুটার গান, দেশে তৈরী একটি বন্দুক, একটি এয়ার রাইফেল, শটগানের ২৬ রাউন্ড গুলি, চারটি পিস্তলের ম্যাগজিন, পিস্তলের ১৭ রাউন্ড গুলি, চারটি গুলির খোসা, ১০ গ্রাম গাঁজা, সাত পুরিয়া হেরোইন, ২০ পিস ইয়াবা, নগদ ৯৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা এবং মেয়রের দুটি সই করা চেক। চেক দুটিতে টাকার পরিমাণ আরও ১৮ লাখ।
তিন বছর আগেও মুক্তার আলীর আধাপাকা টিনশেড বাড়ি ছিলো। এখন সেখানে আভিজাত্যে ভরা দোতলা বাড়ি। বাড়িতে রয়েছে এসি, দামি আসবাব। আছে প্রাইভেটকার। বিলাশী মেয়র মুক্তার কিনেছেন তিনটি মোটরসাইকেলও। এর মধ্যে একটি আর ওফান ফাইভ, এফজেড ভার্সন-২ এবং একটি আরটিআর। নামে-বেনামে কিনেছেন জমি। ছেলে রাজু আহমেদকে করে দিয়েছেন একটি হার্ডওয়্যারের দোকান।
কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন মেয়র? অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, পৌরসভার সব কাজ তিনি দুইজন আওয়ামী লীগ নেতাকে দিয়ে করান। এদের একজন পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুন আলী এবং অন্যজন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়াহেদ সাদিক কবীর। ওয়াহেদ পেশায় শিক্ষক হলেও অন্যজনের লাইসেন্স নিয়ে ঠিকাদারী করেন। ওয়াহেদ ও মামুনের কাছ থেকেই কাজের কমিশন পেয়ে থাকেন মেয়র মুক্তার আলী।
যোগাযোগ করা হলে মামুন আলী বলেন, ‘আমি অতো বড় ঠিকাদার নই। কাজ স্বচ্ছভাবেই করি। টেন্ডারে অংশ নিই, কাজ পাই। অন্য ঠিকাদারও কাজ করেন। ওয়াহেদ সাদিক কবীর মোবাইল ফোনে বিস্তারিত কথা বলতে চাননি। তিনি বলেন, আমি একজন শিক্ষক মানুষ। আমার নামে লাইসেন্স নেই। কাজ করেন কী না জানতে চাইলে বলেন, ‘বাঘায় আসেন, তখন কথা হবে। মোবাইলে না।’
মেয়রের আয়ের উৎস: অনুসন্ধানে মেয়র মুক্তার আলীর আয়ের আরও উৎস পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, আড়ানী থেকে রুস্তমপুর পর্যন্ত রাস্তা সংষ্কারে ৪৫ লাখ টাকার দরপত্র আহ্বান করেছিল পৌর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কোন কাজ না করেই বিল তুলে নেয়া হয়েছে। সেই রাস্তা পরে সংষ্কার করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এই রাস্তা থেকেই মেয়র অন্তত ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আড়ানী পৌরসভায় দুটি হাট আছে। হাট দুটি কখনও স্বচ্ছভাবে ইজারা দেন না মেয়র। সেখান থেকে পান টাকা। পৌর এলাকার সুদ, মাদকের কারবার এবং অবৈধ দোকানপাট থেকে টাকা পান মুক্তার আলী। পৌরসভার তেঁতুলতলা এলাকায় ট্রাক থেকে তোলা হয় টাকা। এই টাকারও কোন হিসাব থাকে না। এ ছাড়া সালিশে গেলে কোন না কোন পক্ষের হয়ে কাজ করেন মেয়র। এতেও নেন টাকা। এভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন মুক্তার আলী।
যেমন পরিবারের সন্তান: মেয়র মুক্তার আলীর বাবার নাম নইম উদ্দিন। এলাকায় তিনি ‘নইম ডাকাত’ হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এলাকার মানুষ এতটাই অতিষ্ঠ ছিলেন যে, তাঁকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়। মুক্তারের বড় ভাইয়ের নাম কালু। তিনিও এলাকার মানুষকে অত্যচার করতেন। প্রায় পাঁচ বছর আগে এলাকার এক ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হয়ে হাসুয়ার কোপে গলা নামিয়ে দিয়েছিলেন কালুর। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান কালু। হামলাকারী ওই ব্যক্তিও সেদিন থেকে লাপাত্তা। আজও এলাকায় ফেরেননি।
অভাব-অনটনের সংসারে অষ্টম শ্রেণি পার হতে পারেননি মুক্তার আলী। প্রথম জীবনে তাঁর আয়ের উৎস ছিলো বাড়িতে পাঠা পোষা। তখন ভারত থেকে গরু, চিনি ও লবণ আসত। মুক্তার আলী তখন চোরাচালান থেকে চাঁদা ওঠাতে শুরু করেন। এভাবেই তাঁর সংসার চলত।
রাজনৈতিক ক্যারিয়ার: মুক্তার আলী ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কিন্তু নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে পরের বছরই তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়। ২০০৬ সালে আড়ানী ইউনিয়ন পরিষদ পৌরসভা হয়ে যায়। তার আগে আড়ানী ইউপির সদস্য হয়েছিলেন মুক্তার আলী। পরবর্তীতে পৌরসভার কাউন্সিলর হন। দিনে হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের বড় নেতা। ২০১৫ সালে পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বাবুল হোসেন। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগের রাতে রহস্যজনকভাবে বিষক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়। মনোনয়ন পেয়ে যান মুক্তার আলী। হয়ে যান মেয়রও। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে যান মুক্তার আলী। চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুজ্জামান। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়ে ভোটে থেকে যান মুক্তার আলী। হামলা-মামলা করেন নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর। ঘটে গোলাগুলিরও ঘটনা। তখন মুক্তার আলীর বিরুদ্ধেও একটি মামলা হয়। সেই মামলায় জামিন না নিলেও নির্বিঘ্নেই তিনি শপথ নেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি।
দুটি ঘটনার যোগসূত্র কী?: মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগের রাতে বিষক্রিয়ায় মারা যান আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল হোসেন। রাত জেগে বাবুলের মদপানের অভ্যাস ছিল। এলাকায় এখনও গুঞ্জন আছে, মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিয়ে বাবুলকে মেরে ফেলা হয়। এ বছর পৌর নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন বাবুলের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা রিবন আহমেদ বাপ্পী। তাঁর মনোনয়ন পাবার সম্ভাবনাও ছিলো। মনোনয়নপত্র বিতরণের কয়েক দিন আগে হঠাৎ এক তরুণী দাবি করে বসেন, বাপ্পী তাঁকে ধর্ষণ করেছেন। এ নিয়ে বাপ্পীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়। মামলার বাদী ওই তরুণী সম্পর্কে মেয়র মুক্তার আলীর ভাগনি।
আড়ানী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, বাবুলের মৃত্যুটা ছিলো রহস্যজনক। এই মৃত্যুর সঙ্গে মুক্তারের যোগসূত্র আছে বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। পরে বাবুলের ছেলে বাপ্পীকে তো ফাঁসিয়েই দেয়া হলো পরিকল্পিতভাবে। সে কারণে নির্বাচনে বাপ্পীও মনোনয়ন পেল না।
কথায় কথায় নির্যাতন-হয়রানি: স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, সব সময়ই মদ্যপ অবস্থায় থাকেন মুক্তার আলী। ভীষণ রগচটা মানুষ তিনি। কথায় কথায় মারধর করেন। পৌরসভায় এমন কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি মেয়রের তাতে লাঞ্ছিত হননি। মাসখানেক আগে লিটন আলী নামে পৌরসভার এক নৈশ্যপ্রহরীকে মাছ কিনতে পাঠান মেয়র। ব্যাগভর্তি মাছ আনার পথে ব্যাগটি ছিঁড়ে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে লিটনের তিনটি দাঁত ভেঙ্গে দেন মেয়র।
পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি আজিবার রহমান নির্বাচনে কাজ করেছিলেন নৌকার পক্ষে। তাই মেয়র মুক্তার ও তাঁর লোকজন পিটিয়ে আজিবারের পা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। নৌকার পক্ষে থাকায় নির্বাচনের সময় ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রহমানের পেটে ছুরি মেরে নাড়িভুড়ি বের করে দেয়া হয়েছিল। মতের সঙ্গে মিল ছিল না বলে ২০১৬ সালে মনিরুল আজম নামে এক কলেজ শিক্ষককে অস্ত্রসহ ধরা হয়েছে বলে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন মেয়র।
সরদা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মনিরুল আজম বলেন, আড়ানীতে মেয়র মুক্তার আলী আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিলেন। সুন্দরভাবে ডেকে তিনি আটকে দেন। এরপর একটা অস্ত্র পাশে রেখে জোর করে ছবি তোলেন। পরে পুলিশের হাতে তুলে দেন। এটা আড়ানীর সবাই জানে। সেই মামলা এখনও চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পৌর এলাকার অসংখ্য মানুষ মুক্তার আলীর নির্যাতন-হয়রানির শিকার। তাঁর মতের সঙ্গে না মিললে তিনি পৌরসভা থেকে কাউকে নাগরিকত্ব, জন্ম সনদ কিংবা প্রত্যয়নপত্রও দেন না। নৌকার ভোট করার কারণে মনোরঞ্জন সরকার নামে এক ব্যক্তি পৌরসভা থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করতে পারেননি। মেয়রের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ কাউন্সিলররাও। সহ্য করতে না পেরে জিল্লুর রহমান নামে এক কাউন্সিলর তো মেয়র মুক্তার আলীকে পিটিয়েছিলেন।
দলের নেতারা কী বলছেন?: আড়ানী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, ‘এমন কোন অন্যায় নেই যেটা মেয়র মুক্তার আলী আড়ানীর মানুষের সাথে করেননি। এ রকম মেয়র আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের। তিনি বলেন, আড়ানীর মানুষ খুব ঠাণ্ডা প্রকৃতির। কিন্তু মেয়র খুব গরম মেজাজের। আমাদের দুঃখ রাখার জায়গা নেই।
রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘এক সময় মুক্তার আলী আওয়ামী লীগের ভাল কর্মী ছিল। পরবর্তীতে তাঁকে আজকের মুক্তার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। কারা তাঁকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এমন সন্ত্রাসী করে তুলল, সেটা তো আমারও প্রশ্ন।’
মেয়র এখন কোথায়?: মুক্তার আলীর বাড়ি থেকে কোটি টাকা, অস্ত্র এবং মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ঘটনায় থানায় আলাদা আলাদা মামলা হয়েছে। সেই অভিযানের আগে থেকেই মুক্তার আলী লাপাত্তা। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। আগের দিন মেয়রের স্ত্রী জেসমিন আক্তার ও দুই ভাতিজা সোহান এবং শান্তকে পুলিশ আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে। মেয়রকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন জানান, মেয়রের হাতে মারধরের শিকার শিক্ষক মনোয়ার হোসেন তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। এছাড়া অস্ত্র এবং মাদক উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ দুটি মামলা করেছে। আর আগে থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে আরও পাঁচটি মামলা আছে। সবমিলিয়ে এখন আটটি মামলার আসামি মেয়র মুক্তার। তাঁকে ঈশ্বরর্দী থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে।
